আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের নেতারা চিরকাল ছাত্রদেরকে হাতিয়ার বানিয়ে যথেচ্ছা ব্যবহার করে আসছে। আবার বিভিন্ন সময় সেই নেতারাই ছাত্রদের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে থাকে। একেই বলে ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’। রাজনৈতিক দলের নেতাদের মতো শিক্ষকরাও ছাত্রদের রাস্তায় নামিয়েছেন। এর ফল তারাও ভোগ করবেন। এই আশঙ্কায় আজকে আমার লেখা। এই লেখা পড়ে হয়তো অনেকে আমার বিরুদ্ধাচরণ করবেন। তবুও আমি লিখছি।
শিক্ষক সমাজ জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত। তাদের দায়িত্ব জ্ঞানচর্চা, নৈতিক শিক্ষা ও দেশ গঠনের পথে নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে আন্দোলন করছেন, এমনকি কখনো কখনো শিক্ষার্থীদেরও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করছেন। এ ধরনের প্রবণতা শিক্ষাক্ষেত্রের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনতে পারে।
আমি এর কুফল নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণঃ
প্রথমত, শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়। যখন শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে রাজপথে নামেন, তখন শিক্ষার্থীদের পাঠদানের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। দীর্ঘদিন ক্লাস বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যায়, পরীক্ষার প্রস্তুতি নষ্ট হয়, এবং একাডেমিক ক্যালেন্ডার বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। এতে করে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার মান অবনতির দিকে ধাবিত হয়।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যখন শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক বা আন্দোলনমুখী কাজে ব্যবহার করা হয়, তারা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ভুলে যায়। তাদের মনে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়। রাজপথে স্লোগান দেওয়া বা সংঘাতে জড়ানো তাদের কোমল মনের উপর বিপজ্জনক প্রভাব ফেলে।
তৃতীয়ত, সমাজে শিক্ষকদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। একজন শিক্ষক সমাজে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু যখন তিনি রাস্তায় অবরোধ, সংঘর্ষ বা বিশৃঙ্খলার সঙ্গে যুক্ত হন, তখন সাধারণ মানুষ শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা হারায়। সমাজে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়।
চতুর্থত, রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও বিপর্যস্ত হয়। শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে নামে, তখন ট্র্যাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। অনেক সময় এই আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ ধারণ করে, যার ফলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ নাগরিক— সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সবশেষে বলা যায়, দাবি আদায় করা শিক্ষকদের অধিকার হলেও পদ্ধতিটা হতে হবে শান্তিপূর্ণ ও শিক্ষাবান্ধব। রাজপথ অবরোধ বা শিক্ষার্থীদের ব্যবহার না করে আলোচনার মাধ্যমে, নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সমাধান খোঁজা উচিত। কারণ শিক্ষক যদি জ্ঞান ও নৈতিকতার মডেল না হন, তবে শিক্ষার্থীরা সঠিক পথে চলতে পারবে না।
শিক্ষক সমাজের শক্তি রাজপথে নয়, শ্রেণিকক্ষে। শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে, নৈতিকতার পাঠ দিয়ে এবং যুক্তিবোধ জাগিয়ে তোলাই তাদের আসল সংগ্রাম। তাই শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামানো নয়, তাদের মননে আলোর প্রদীপ জ্বালানোই হওয়া উচিত প্রকৃত শিক্ষকের কর্তব্য।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার ও সোনামুখ স্মার্ট একাডেমি ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা।
খুলনা গেজেট/এএজে

